শারিরীক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি রুহুল আমীনকে

ষ্টাফ রিপোর্টার: ত্রিশ বছরের যুবক রুহুল আমীন একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় একবার তার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিলো। তাতে পোলিও আক্রান্ত হয়ে দুই পা প্রায় অচল হয়ে যায়। তারপর থেকে সে একাকী দাড়াতে পারে না। বসে বসেই পথ চলতে হয় তাকে। এমন একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে গরুর খামার করে সফলতা পাওয়া কষ্টকরই না দুঃসাধ্যও বটে। তবে শারিরীক এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর মনোবলে দুঃসাধ্যকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে রুহুল আমীন। নিজের বাড়িতে গরুর খামার গড়ে দৃষ্টান্ত গড়েছে। এখন সে সফলতার মুখ দেখছে। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি মানেই অপরের বোঝা নয়; প্রতিবন্ধীরা উদ্যোক্তাও হতে পারে এমন নজির সৃষ্টি করেছে সে। ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা তার এই গরুর খামারের সম্প্রসারণের জন্য এখন সংশ্লিষ্ট দফতরের সহায়তা জরুরী।

বছর দুয়েক আগে একটি গাভি দিয়ে গরু প্রতিপালনের কাজ শুরু করেছিলো রুহুল আমীন। এখন তার খামারে গরু ও গাভীর সংখ্যা পাঁচটি। এরই মধ্যে ৪৪ হাজার টাকায় একটি এড়ে বাছুর বিক্রি করে আরেকটি বক্না বাছুর কিনেছে । প্রতিদিন খামারে মিলছে প্রায় ২৫ লিটার দুধ।

রুহুল আমিনের বাড়ি মধুখালী উপজেলার মেগচামী ইউনিয়নের চর মেগচামী গ্রামে। প্রবীণ কৃষক মোঃ বিল্লাল হোসেন ও সামসুননাহার বেগমের জেষ্ঠ্য পুত্র সে। ছয়-সাত বছর বয়সে টাইফয়েড রোগে তার দু’পা পোলিওতে আক্রান্ত হয়। তারপর থেকে সে আর উঠে দাড়াতে পারেনি। তবে প্রতিবন্ধীতা তার চলার পথের প্রতিবন্ধক হতে পারেনি। অদম্য চেষ্টায় ঘুরে দাড়িয়েছে সে। এই প্রচেষ্টায় তার প্রধান সহযোগী হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রী।

রুহুল আমিন জানান, গ্রামের মাদ্রাসায় সামান্য পড়াশুনা করার পর অর্থাভাবে এগোতে পারেননি। সাত বছর আগে ২০১১ সালে পাশের রাজবাড়ি জেলার জামালপুর ইউনিয়নের খামার মাগুড়া গ্রামের ঝর্ণা বেগম (২৫) এর সাথে বিয়ে হয়। সংসারের আয় রোজগার বাড়াতে নতুন কিছু করার চেষ্টা করতে থাকেন। বাড়ির সামনে একটি মুদি দোকান দিয়েছিলেন। তাতে আয়-রোজগার তেমন হতো না। স্ত্রীর পরামর্শে প্রথমে বাড়িতে হাস-মুরগি পালন শুরু করেন। তারপর ছাগল পালন। এভাবে কিছু টাকা জোগাড় করে শুরু করেন গরুর প্রতিপালন।
শুরুতে বয়োবৃদ্ধ পিতা বিল্লাল হোসেন কৃষি জমি বন্ধক রেখে তাকে ৮০ হাজার টাকা দেন। সেই টাকার সাথে আরো কিছু টাকা জোগাড় করে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাছুরসহ একটি ক্রস গাভী কিনেন পাশের নাড়–য়া গ্রাম হতে। প্রথমে গরু পালার জন্য উপযোগী তেমন গোয়াল ঘরও ছিল না। একটি ঘরে ইট বিছিয়ে সেখানেই শুরু করে সেই গাভী ও বাছুরের প্রতিপালন। সেই গাভী হতে পরের বছর একটি ফ্রিজিয়ান জাতের বকনা বাছুর জন্ম নেয়। পরের বছরের মধ্যেই গাভীর সাথে কিনে আনা সেই বকনা বাছুরও বড় হয়ে যায়। এবছর এই দু’টি গাভী হতে জন্ম নিয়েছে আরো দু’টি বাছুর। এভাবে বাড়ছে তাদের খামার।

রুহুল আমিন জানান, দৈব-দুর্বিপাক ছাড়া এসব গাভী হতে প্রতিদিন কমবেশি প্রায় ২৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়। যা বিক্রি করে ১২শ’ টাকার মতো আয় হয়। খামারে গরুর প্রতিপালনে ৬ থেকে ৭শ’ টাকা দৈনন্দিন খরচ হয়। সংসার খরচ ছাড়াও এর পাশাপাশি আরো কিছু খরচ হয়। সামান্য কিছু সঞ্চয়ও করেন। রোগ বালাই নিরসনে কিছু বাড়তি খরচ ব্যায় করতে হয়। এতে খামারের ও সংসারের খরচ মিটে যায়। গরু-বাছুরের তেমন বড় ধরনের রোগবালাই হয় না। মাঝেমধ্যে টিকা ও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে যা খরচ।

রুহুল আমিন বলেন, আমি গরুর খাবার দিতে পারি না। শুধু ঘাস কাটতে পারি। আর গরুর গোসল থেকে শুরু করে খামারের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও খাবার দেয়ার পুরো কাজটাই ঝর্ণা করেন। মানসিক প্রতিবন্ধী এক ছোট ভাই রয়েছে। সে গরুর ঘাস কাটার কাজে সহায়তা করে।

এরমধ্যে সে ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে একটি এড়ে বাছুর বিক্রি করেছেন। আবার ৩৬ হাজার টাকা দিয়ে আরো একটি বকনা বাছুর কিনেছেন। এড়ে বাছুর প্রতিপালন করে কোরবানীর সময় বিক্রি করতে পারলে এককালীন মোটা অংকের টাকা পাওয়া যাবে। এজন্য খামার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রায় ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ইতিমধ্যে ১০টি গরু প্রতিপালনের উপযোগী একটি শেড নির্মাণ করেছেন। এখন এই খামারের সম্প্রসারণ প্রচেষ্টায় তাদের অবশ্য সরকারী সহায়তা জরুরী।

সবমিলিয়ে দেখা গেছে, শারিরীক প্রতিবন্ধী রুহুল আমিনের পথচলা মোটেও মসৃন ছিলো না। তবে তার অদম্য মনোবলের কাছে কিছুই থেমে যায়নি। এই উদ্যোগে স্ত্রী ঝর্ণা বেগমের সহায়তা তার সাফল্যের চাবিকাঠি। মূলত: তাদের দু’জনের উদ্যোগে গরুর খামার গড়ে এই পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রতিবন্ধী রুহুল আমিন খামার সম্প্রসারণে সরকারী সহায়তা আশা করছেন। তবে তাদের গরুর খামারটি এখনো প্রাণী সম্পদ দফতরের রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত হয়নি। শিঘ্রই এটি প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের রেজিষ্ট্রেশন পাবে বলে তারা আশা করছেন। কৃষি ব্যাংক কিংবা কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে লাখ দু’য়েক টাকার ঋণ সহায়তা জরুরী। গরুর পাশাপাশি টারকি মুরগি প্রতিপালন শুরু করেছেন তারা।

রুহুল আমিনের স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে গরুর খামারটি এই পর্যন্ত আনতে পেরেছি। এখন সরকার যদি আমাদের খামারটি পরিদর্শন করে আর্থিক সহায়তা করে তবে আমরা খামারটি বাড়াতে পারবো।

এব্যাপারে মধুখালী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. প্রিটিস কুমার দাস বলেন, খোঁজখবর নিয়ে দেখবো প্রয়োজনীয় সহায়তা করা যায় কিনা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments