হাসানুজ্জামান সাকী, নিউ ইয়র্ক থেকে:
ঘটনা এক. নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানের ইস্ট হার্লেম এলাকায় রাতের অন্ধকারে এদিক-ওদিক ছুটছেন এক নারী। চিৎকার করে সাহায্য চাইছেন। কাছেই ছোট একটা শিশু ফুটপাতে পড়ে আছে। শিশুটি কাতরাচ্ছে। জানা গেল, ললিপপ খেতে গিয়ে শিশুটির গলায় সেটি আটকে গেছে। দুই বছরের ছেলেটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে না। ৯১১-এ কল করে কখন অ্যাম্বুলেন্স আসবে, কখন হাসপাতালে নেয়া হবে শিশুটিকে, ততক্ষণে তো বড় অঘটন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। শিশুটির মা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। এদিক-ওদিক ছুটছেন।
ওই এলাকায় ডিউটি করছিলেন দুজন কাউন্টার টেরর অফিসার। তারা চিৎকার শুনে ছুটে এলেন। অফিসারদের মধ্যে একজন সাহস করে শিশুটির গলা থেকে ললিপপটি বের করে আনার চেষ্টা করলেন। তিনি “হাইমলিক ম্যানুভার” টেকনিক প্রয়োগ করে সত্যি সত্যি শিশুটির গলা থেকে ললিপপটি বের করে আনলেন। ২০১৭ সালের ২৩ আগস্টের ঘটনা এটি।
ঘটনা দুই. ২০১৬ সাল। ১৯ সেপ্টেম্বর দিন পেরিয়ে গভীর রাত। সময় ১টা ২০মিনিট। পশ্চিমের দেশগুলোতে এই সময়কে আর্লি মর্নিং বলে থাকে। আমরা বলি মধ্য রাত। একে তো রাত তার ওপর শীতের হাওয়া বইছে ব্যাটারি পার্ক এলাকার হার্ডসন রিভারের পাড়ে। হঠাৎ মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিলেন। পুলিশের দুজন অফিসার তখন ওই এলাকায় ডিউটি করছেন। কেউ একজন লোকটির নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে কাছের ডিউটিরত পুলিশদের অবহিত করলো। দুজন পুলিশ অফিসারের মধ্যে একজন ইউনিফর্ম খুলে দ্রুত পানিতে ঝাঁপ দিলেন লোকটিকে বাঁচাতে। অপর পুলিশ সহকর্মীটি হতবাক। হতবাক পথচারীটিও।
এ ঘটনায় সঙ্গী পুলিশ অফিসারটি এতটাই হকচকিয়ে গেলেন যে তিনি বাড়তি ফোর্স ও উদ্ধারকর্মীর জন্য নিজের ওয়্যারলেসে ম্যাসেজটি ঠিকমতো দিতে পারছিলেন না।
পানিতে একজনকে বাঁচিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। এ ধরনের ঘটনায় অনেক সময় ডুবে যাওয়া ও উদ্ধারকারী দুজনরই প্রাণ-সংহার ঘটে থাকে। উদ্ধারকারী পুলিশ অফিসারের অবস্থাও বেগতিক হয়ে উঠলো। ততক্ষণে এনওয়াইপিডির উদ্ধারকর্মীরা নদীপথে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছালে চুয়ান্ন বছর বয়সী লোকটিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। প্রাণে বেঁচে যান সাহসী পুলিশ অফিসারটিও।
ঘটনা তিন. ২০১৫ সাল। ঘটনাস্থল ম্যানহাটানের একটি সাবওয়ে স্টেশন। আত্মহত্যার জন্য সাবওয়ে ট্র্যাকে (রেল লাইন) ঝাঁপ দেয় এক তরুণ। যাত্রীদের মধ্যে একজন তা দেখে ডিউটিরত দুজন পুলিশ অফিসারকে জানায়। অফিসার দুজন দুই বাউন্ডের লাইনের দুইদিকে দৌড়ে যায়। এদের মধ্যে একজন তার দিকের লাইনে লোকটিকে পড়ে থাকতে দেখে। ততক্ষণে ট্রেন কাছাকাছি চলে এসেছে। পুলিশ অফিসারটি লাফ দিয়ে পড়ে ট্র্যাক থেকে তরুণটিকে উপরে তুলে আনতে সক্ষম হন।
ঘটনা চার. লাস ভেগাসের শুটিংয়ের কথা মনে আছে? মিউজিক ফেস্টিভালের পাশে ম্যান্ডেলে বে হোটেলের বত্রিশতলা থেকে চলমান কনসার্টের ওপর এক বন্দুকধারী গুলি চালিয়েছিল!! ২০১৭ সালে ওই ঘটনায় ঘাতকসহ মারা গিয়েছিল ৫৯ জন।
ঘটনাটা বলছি এ কারণে যে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর। নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে। একটি বিল্ডিং থেকে পথচারীর ওপর গুলি ছুঁড়েছিল এক বন্দুকধারী। গুলিতে একজন নির্মাণ শ্রমিক ও একজন নারী গুলিবিদ্ধ হয়। খবর পেয়ে সেখানে রাশ করে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে উদ্ধারের সময় এক পুলিশ অফিসারের ঘাড়ে এসে একটি গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তিনজনই। পরে পুলিশ ওই বিল্ডিং থেকে ১৯ বছর বয়সী বন্দুকধারীকে গ্রেফতার করে।
উপরের চারটি ঘটনার নায়ক একজন। বাংলাদেশি আমেরিকান তিনি। নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ-এনওয়াইপিডির কাউন্টার টেরর অফিসার। চারটি ঘটনাই যুক্তরাষ্ট্রের বড় সব প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশি এই বীরের নাম রাজুব ভৌমিক রাজু। ২০১২ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে যোগ দেন। রাজু একজন সাহসী বীরই নন শুধু, তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সেই গল্প এখন বলছি।
রাজু এনওয়াইপিডির কাউন্টার টেরর অফিসার। একাধারে নিউ ইয়র্কের দুটি কলেজের অধ্যাপক। জন জে কলেজে ক্রিমিনাল জাস্টিস এবং হসটস কলেজে সাইকোলজি বিষয়ে পড়ান তিনি। এসবের বাইরে তিনি নিয়মিত কবিতা, ছড়া ও উপন্যাস লেখেন। তিনি একজন গবেষকও।
রাজুর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এগার। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা থেকে বইগুলো বেরিয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বই জন জে-তে নিয়মিত পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়। বইগুলো হলো: “লিডিং থিউরিজ অব ডেলিনকুয়েন্ট বিহেভিয়ার এন্ড ক্রিমিনালোজি”, “অ্যাকটিভ শুটার: মোটিভস, মেথডস, মেডনেস” এবং “স্লিপ রেগুলেশান: প্রিভেন্টিন ডিপ্রেশান”।
প্রায় পাঁচ শতাধিক সনেট কবিতা লিখেছেন তিনি। এই মুহুর্তে তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ের সংখ্যা আটটি। সেগুলো হলো: ব্রুকলিন ব্রীজ (প্রেমের উপন্যাস), মার্কস অব এক্সিসটেন্স (কাব্যগ্রন্থ), স্বতন্ত্র চতুর্দশপদী (কাব্যগ্রন্থ), স্বতন্ত্র চতুর্দশপদী ভলিউম-২ (কাব্যগ্রন্থ), আল-কায়েদা (গবেষণাধর্মী), আইসিস এন্ড ওয়ার্ল্ড (গবেষণাধর্মী), ব্রোকেন উইন্ডোজ (পাঠ্যবই) এবং আ্যবনরমাল সাইকোলজি (পাঠ্যবই)। সবগুলো বই এ বছর মার্চের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
আরও শুনবেন? যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দুটি বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। আরও দুটি বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ড হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং মিনেসোটার ওয়াল্ডেন ইউনিভার্সিটি থেকে ফরেনসিক সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছেন।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক থেকে ইন্সট্রাকশন এন্ড এডুকেশন বিষয়ে মাস্টার্স করছেন এখন। সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করতে সম্প্রতি ভর্তি হয়েছেন বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে।
আরও শুনুন। রাজুব ভৌমিক দুটি বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন। সাইকোলজি ইন ক্লিনিকাল সাইকোলজি ও সাইকোলজি ইন ফরেনসিক সাইকোলজি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন যথাক্রমে ক্যালিফোর্নিয়ার সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি এবং মিনেসোটার ওয়াল্ডেন ইউনিভার্সিটি থেকে।
গল্প শেষ হয়নি। আরও দুটি বিষয়ে ডক্টরেট করছেন তিনি। আমেরিকান কলেজ অব এডুকেশন থেকে এডুকেশন ইন লিডারশীপ বিষয়ে এবং বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে পিএইচডি করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে।
রাজুব ভৌমিক রাজুর বয়স ২৯ বছর। তাঁর বাবার নাম মিসর ভৌমিক, মা পুতুল ভৌমিক। তারা দুই বোন এক ভাই। বাংলাদেশে বাড়ি নোয়াখালীর কবিরহাট থানার শ্রীনদ্দি গ্রামে। সেখানে ওটার হাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট সরকারি মুজিব কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাবার সূত্রে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ২০০৫ সালে।
বাংলাদেশের মফস্বল শহরের সতেরো বছরের একটি ছেলে এইচএসসি পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে এসে মাত্র বার-তেরো বছরে কিভাবে এতকিছু করলো?
সেই গল্প আরও অবাক করার মতো। মা ও দুই বোনকে নিয়ে এদেশে আসার পর রাজুকে অনাকাঙ্খিত প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এসে তিনি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ওঠেন। সেখানে প্রথমে ম্যাকডোনাল্ড ও সাবওয়ে রেস্টুরেস্টে কাজ করতেন। শুরুর দিকে সামনে ক্যাশ কাউন্টারে ডিউটি দেয়া হতো না তাকে। অনেক দিন কাজ করেছেন পিছনে কিচেনে। এ অবস্থায় রাজু অর্থ জমিয়ে একটি সাবওয়ে কিনেন মেরীল্যান্ডে। ভর্তি হন কলেজে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনাও চালিয়ে যান। এভাবে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
পড়াশোনা-জ্ঞান আহরন যেন নেশা রাজুর। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জেদও হয়তো। এরপর একে একে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে থাকেন।
একজন মানুষের পক্ষে এতকিছু করা কিভাবে সম্ভব? প্রশ্ন ছিল রাজুর কাছে। শুরুতে তিনি উল্লেখ করলেন স্ত্রীর কথা। বললেন, স্ত্রীর জন্য সম্ভব হয়েছে। বিষয়টি রাজু খোলাসা করেননি। হয়তো বলতে চাইলেন, কাছের মানুষের মানসিক সহযোগিতা পেলে যে কেউ অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে। রাজুর সাথে বিয়ে হওয়ার পর স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা ঘোষ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। এখন তিনি চাইল্ড এডুকেশনে পড়াশোনা করছেন এখানে।
আবারও প্রশ্ন করি তাকে। এতকিছু করার সময় পান কিভাবে? রাজু জানালেন, দিনে চার ঘণ্টা ঘুমান তিনি। প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এনওয়াইপিডির ডিউটি করেন। রাতে তার ডিউটি করার কারণ দিনে তাকে কলেজে পড়াতে হয়। রাজু বললেন, সপ্তাহে দুদিন ছুটির দিনে তিনি ১০ ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে সপ্তাহের ঘুমের চাহিদাটা পূরণ করে নেন। একজন মানুষের যে দিনে ছয় ঘণ্টার ঘুমের প্রয়োজন।
রাজু স্ত্রী-কন্যা-মাকে নিয়ে নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে থাকেন। নিজের বড় ও ছোট দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন এখানে।
রাজুব ভৌমিকের মতো মানুষগুলো আমাদের আশাপাশেই থাকেন। আমরা কেউ তাকে চিনি। অনেকেই চিনতে পারি না। এরাই আমাদের বাস্তব জীবনের বিস্ময় মানব, সত্যিকারের নায়ক। এদের কারণেই আমরা আলোকিত হচ্ছি, আমরা গর্বিত হচ্ছি, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজু আমাদের প্রবাস জীবনের কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষগুলোর জন্য তো বটেই, যেকোনো মানুষের জন্যই এক বড় উদাহরণ, আদর্শ মানুষ।