সেদিন ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের শহরে। স্লোগানে কেঁপেছিল ঢাকার রাজপথ, সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি। আকাশে ছিল বৃষ্টির ঘনঘটা। বাতাসের তান্ডবে ছিল ঝড়ের প্রচন্ডতা। সেদিনের ঝড়-বৃষ্টিও প্রতিরোধ করেতে পারেনি লাখো মানুষের মিছিলকে। ঢাকার কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে শেরেবাংলা নগরে অপ্রতিরোধ্য মানুষের ঢলে সেদিন যে বার্তা ছিল, তা যেন ছিল বিধাতার ইচ্ছারই বর্হিপ্রকাশ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৮ বছর আগে এই দিনে স্বদেশে প্রত্যাবর্তণ করেছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দীর্ঘ নির্বাসনের ইতি টেনে পদার্পণ করেছিলেন এই বাংলার মাটিতে, যেখানে ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে।
১৯৭৫ সালের আগষ্টে মোস্তাকচক্রটি অত্যন্ত সুকৌশলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছি। একাত্তরের পরাজিত শক্তির সফল অগ্রযাত্রা সেই থেকে চলতে থাকে এবং প্রায় বাধাহীন ভাবেই এই বাংলার মাটিতে। তারপর শুরু হয়েছিল প্রতিশোধের রাজনীতি আর মুক্তিযোদ্ধা নিধন। তা শুরু হয়েছিল প্রথমে মূল সেনাবাহিনীতে,তারপর বেসামরিকদের উপর। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেই জারি করেছিলেন ইনডেমনিটি আইন। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিশেষ বিমানযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। বিভিন্নভাবে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল হত্যাকারীদের। তারপর সেনাছাউনি থেকে গঠন করা হয়েছিল বিএনপি নামের পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল। জাতির পিতার জীবদ্দশায় বাকশালের অতিউৎসাহী সদস্য হয়েও জেনারেল জিয়া বাকশালের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে বাংলার মাটিতে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিল রাজনীতি থেকে বিতাড়িত জামায়াত ইসলামীকে। আওয়ামী লীগ তখন নিপাতিত একটা দল, যার নেতৃত্ব নেই, কর্মীরা আত্নগোপনে অথবা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা একটি দল মাত্র।
পচাত্তর পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরতে বাঁধা দিয়েছিল। তাঁদের ভয় ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় দেশে ফিরলে পাকিপন্থি অপশাক্তি নস্যাৎ হবে, বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গতি পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার। দেশে ফিরতে না দিলেও ১৯৮১ সালের ১৩-১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেব। ঠিক যেই কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের দুইভাগ হওয়ার সম্ভবনা ছিল, অথচ অনুপস্থিত শেখ হাসিনার নামেই একিভূত হলো একই পতাকাতলে। সেদিনের কাউন্সিলে জননেতা তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবনায় যখন শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেদিন কাউন্সিলে বয়ে গিয়েছিল আনন্দের বন্যা। বাঙালীরা জাতির পিতার প্রতি ঋণশোধ হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করে কিছুটা হয়ত হাল্কা হতে পেরেছিলেন সেদিন। বাঙালীর দেয়া ভালবাসার দায় শুধিতে সেই থেকে শুরু জননেত্রী শেখ হাসিনার পথ চলা। অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নীচে সমাবেশ ঘটাতে প্রয়াস পেয়েছিলেন স্বাধীনতার পায়রাগুলোকে। তাঁর এ দীর্ঘ পথ চলা সহজ ছিল না। অনেক জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেও মাথা নত করেননি কোন চোখ রাঙানীর কাছে। পদদলিত করেছেন লোভের লিপ্সাকে। নিজের পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বাংলার জনগণকে আত্মার আত্মীয় ভেবেছেন। তাঁদের জন্য উৎসর্গ করেছেন চলার পথে জীবনের প্রতিটা দিনকে।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র একশ্রেনীর মানুষের ভোগবিলাসের উপকরণ হতে পারে না, বরং শোষিত-অবহেলিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির যে মন্ত্র তার নামই গণতন্ত্র! তাঁর সে স্বপ্ন পূরনের আগেই ঘাতকচক্র তাঁকে হত্যা করে স্বপ্ন পূরণের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। পিতার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণের পণ করেই জননেত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন দেশকে। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে মানুষের ভাগ্য, বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশও। এসবই সম্ভব হয়েছে ৩৭ বছর আগে এই দিনে তিনি স্বদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন বলেই! ৩৭ বছর আগে জননেত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে মানুষের বাসযোগ্য করতে জীবনপণে যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন, আজ তা ফল দিতে শুরু করেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা নিয়ে একাত্তর এসেছিল, সে চেতনাকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব থাকবে না বলে জননেত্রী দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। বাংলাদেশ জঙ্গীমৌলবাদের ঘাটি হতে পারবে না বলে উৎখাত করেছেন জঙ্গীবাদকে। শিক্ষার হারবৃদ্ধিই শুধু নয়, দেশকে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত করেছেন তিনি। অনুন্নত দেশ থেকে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নিত করেছেন। তিনি বিশ্বমোড়লদের চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষে যা করার দরকার তা করছেন নির্দ্বিধায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিচার করেছেন জাতির পিতার হত্যাকারীদের। দেশকে সুশাসনের দিকে এগিয়ে নিতে কালোশক্তিগুলোকে গুড়িয়ে দিয়েছেন মাটির সাথে।
তারপরেও থেমে নেই তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তের। অথচ নির্ভিক যে জাতির পিতার সন্তান তিনি কোন ভয়কেই ভয় মনে করেননি। বাংলার জনগণ যার আত্মীয়, তাঁর ভয় কিসের! দীর্ঘ ৩৭ বছরের প্রতিটা দিন জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশের গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। নিজের সুখ-বিলাসের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশকে আধুনিক বাংলাদেশে পরিণত করতে তিনি বিরামহীন কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ছাড়াও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা আজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে দৃঢ় করতে প্রত্যয়ী হবে আগামীতেও!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার ৩৮তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁর দীর্ঘায়ূ ও সুস্থ্যতা কামনা করছি।
সাব্বির খান
লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট