রিয়াজুল ইসলাম, মোহাম্মদ মফিজুল হক ও এ এইচ এম আব্দুল হাই
বন, ২৯ জুলাই (আওয়ার ভয়েস) — জার্মানিতে বসবাসরত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থী কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের একটি বড় অংশ অবৈধ কাজের মাধ্যমে আয় এবং টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত। এমনকি অবৈধ কাজ ও টাকা পাঠাতে গিয়ে তারা নিজেরাও হচ্ছে প্রতারণার শিকার। আওয়ার ভয়েসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সেই চিত্র।
আফগানিস্তান থেকে প্রায় দুই বছর আগে জার্মানিতে এসেছেন রাশিদ (ছদ্মনাম)। এখানে শরণার্থী হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছেন। সে কারণে প্রতিমাসে জার্মান সরকারের কাছ থেকে মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন। আরও আছে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্তও। মানবিক কারণে আর সব শরণার্থীদের মত রাশিদেরও সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে জার্মানির সরকার। কিন্তু জার্মান সরকার জানে না যে গত প্রায় দুই বছরে ২০ হাজার ইউরো আফগানিস্তানে পাঠিয়েছেন রাশিদ। এবং এর পুরোটাই অবৈধভাবে আয় করা এবং অবৈধ পথে দেশে পাচার করা।
ন্যায্য মজুরীবিহীন কালো কাজের খপ্পরে
জার্মানিতে যারা শরণার্থী কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বাস করেন তাদের শুরুতেই কোন কাজ করে উপার্জনের অনুমতি দেওয়া হয় না। রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থণার কমপক্ষে তিন মাস পর কাজের অনুমতি দেওয়া হলেও তাতে থাকে বেশ কিছু শর্ত। তবে ১৫ মাস কাজের পর তাদের জন্য কাজের অনুমতি থেকে সেসব শর্ত তুলে নেওয়া হয়। এই দীর্ঘ সময়ে কিন্তু কেউ বসে থাকেন না। শরণার্থীদের অধিকাংশই বিভিন্ন দোকান কিংবা রেস্তোঁরাতে ঘুরতে থাকেন গোপনে কাজ করার সুযোগের সন্ধানে। কাজের সন্ধানও মিলে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বয়সে তরুণ এসব শরণার্থীর কপালে। জার্মানিতে প্রতি ঘণ্টার মজুরি সাড়ে আট ইউরো করে আইন করা হলেও তারা এক্ষেত্রে পেয়ে থাকেন মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ইউরো করে। যেমনটি আফগান শরণার্থী রাশিদ গত দুই বছর ধরে কাজ করছেন ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ ইউরো করে। তিনি বলেন, এখানে একজন বৈধ শ্রমিকের প্রতি ঘণ্টায় মজুরী প্রায় নয় ইউরো। অথচ আমাকে মালিক দেয় ঘণ্টায় পাঁচ ইউরো করে।
এই ধরণের অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশ থেকে আসা নাগরিকদেরও হয়েছে। বাংলাদেশী নাগরিক নিয়াজী (ছদ্মনাম) দুই বছর আগে লিবিয়া থেকে সাগরপাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসেছেন। গত বছর তিনি বন শহরের এক রেস্তোঁরাতে কাজ করতেন। সপ্তাহে ছয়দিন বিকেল পাঁচটা থেকে কমপক্ষে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এজন্য সপ্তাহ প্রতি পেতেন মাত্র ২০০ ইউরো করে। কাজের কোন অনুমতি না থাকাতে সেটাই তাকে নিতে হতো।
পাকিস্তানের লাহোর এলাকা থেকে প্রায় চার বছর আগে জার্মানিতে আসা খুরশেদ (ছদ্মনাম) বলেন, “এখানে আসার পর যখন কাজের অনুমতি পাইনি তখন দিন-রাত কী করে কাটাবো এই ভেবেই পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে একটি কালো কাজ পাওয়ার চেষ্টা করি। এখন পর্যন্ত কালো কাজের জগত থেকে আর বের হয়ে আসতে পারিনি।
”আরেক বাংলাদেশী রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী ফারুক গত দুই বছরে একাধিক জায়গায় কাজ করেছেন। তবে সেগুলো সবই কালো কাজ। তিনি বলেন, “অনেক মালিকই কাজ দিতে চায়। তবে তারা কাজের চুক্তি সই করতে চায় না। কারণ তাহলে একজন কর্মচারীর পেছনে তাদের চার-পাঁচশ ইউরো বেশি খরচ হবে। এজন্য তারা কালো কাজে লোক নিতে বেশি আগ্রহী। আর আমাদের কোন কাজের অনুমতি না থাকার কারণে আমরাও সেটা নিই।“
অবৈধ পন্থায় টাকা পাচার
জার্মানির শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক ফেডারেল দপ্তর বিএএমএফ এর হিসাব অনুসারে জার্মানিতে বর্তমানে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ নয় হাজার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন জমা হয়েছে প্রায় এক লাখ বারো হাজার। শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করা এই ১১ লাখ মানুষ জার্মানিতে তাদের বসবাসের বৈধতা না পাওয়া পর্যন্ত ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম, রিয়া কিংবা এমন ধরণের মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের দেশে আত্মীয়-স্বজনের কাছে টাকা পাঠাতে পারেন না।
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, “আমি এখানে আসার পর থেকেই কালো কাজ পেয়ে যাই। কাজের ওখানেই মালিক একটি ঘরে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু আমার কাজের অনুমতি থাকলে আমি যত বেতন পেতাম এখন তার তিন ভাগের এক ভাগ পাচ্ছি। আবার দেশে টাকা পাঠাতে গেলেও হুন্ডির কারণে বিনিময় হার কম পাই। ফলে সব দিক থেকেই আমরা ঠকছি।“অবৈধ উপার্জিত টাকা দেশে পাঠাতে এবার তাদের ধরতে হয় ভিন্ন পন্থা। এবার তারা খুঁজে পান এমন কিছু দেশী ভাইদের যারা হয়তো ইউরোপে বহুবছর আছেন এবং এখানে তাদের কাছ থেকে ইউরো গ্রহণ করেন, আর বাজার দরের চেয়ে কিছু কম দামে নিজের দেশে ওই শরণার্থীর কোন আত্মীয়কে দেশী মুদ্রায় টাকা দিয়ে দেন। সেখানেও রয়েছে বাজার দরের চেয়ে কম দামে টাকা বিনিময়ের যন্ত্রণা। এমনভাবে গত চার বছরে প্রায় ৭০ হাজার ইউরো দেশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে জার্মানিতে আসা রুহুল (ছদ্মনাম)।
বড় অংকের রাজস্ব ক্ষতি
জার্মান দপ্তর বিএএমএফ এর হিসাবে, শরণার্থীদের প্রায় ৫০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। যদি তারা কালো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে সেই হিসেবে জার্মানিতে অবস্থানরত প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থী এভাবে কালো কাজে জড়িত। তারা যদি প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ হাজার ইউরো নিজ দেশে পাঠান, তাহলে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি ইউরো সরকারি কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে জার্মানি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
এতে জার্মান সরকার কোটি কোটি টাকার কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দক্ষিণের দেশগুলোও নিজেদের অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সঠিক হিসাব পাচ্ছে না। এর সঙ্গে রয়েছে এসব রেমিট্যান্স মাদক চোরাকারবারি কিংবা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা।
নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক অভিবাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা বাসুগ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও রেমিট্যান্স বিশেষজ্ঞ বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া শরণার্থীদের এমনভাবে প্রতারিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, “আসলে বাধ্য না হলে এমনভাবে জীবন বাজি রেখে কেউ দেশ ছেড়ে আসতো না। কিন্তু ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় এসেও যখন কাজের অনুমতি পায় না, তখন অবৈধভাবে স্বল্প মজুরীতেও তারা কাজে লেগে যাচ্ছে এবং প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও কালো কাজের বাজারকেই তারা আঁকড়ে ধরে থাকছে। তাই ইউরোপের দেশগুলোর সরকার যদি বিশেষভাবে সুস্থ-সবল শরণার্থীদের দ্রুত কাজের অনুমতি প্রদান করতো, তাহলে তারা শুরু থেকেই বৈধভাবে এবং ন্যায্য বেতনে কাজ করতে পারতো। এর ফলে সরকারও যথাযথ আয়কর পেতো।”
শরণার্থীদের হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা বাসুগ এর পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছি এবং দাবি জানিয়ে আসছি অভিবাসীদের বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স প্রেরণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে। বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে উভয় সরকারের যেমন লাভ, তেমনিভাবে সমাজের জন্য তা উপকারী। কারণ বৈধভাবে টাকা দেশে গেলে সেটা দিয়ে কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া যায়। এছাড়া এধরণের উদ্যোগ বা প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেদেশের সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই এসব শরণার্থীরা যেন বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে পারে সেব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।”