আমি আওয়ামী লীগ বা সরকারের কেউ নই। আমি একাত্তরের পক্ষ-মতাদর্শের একজন বাঙালী মাত্র। আজ মুহম্মদ জাফর ইকবার স্যার একটি কলাম লিখেছেন, যা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে (https://goo.gl/EE7MHw)। লেখার বিষয়বস্তু ছিল গ্রেফতারকৃত ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম। শহিদুল আলম সাহেবের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের বিচারিক বিষয় এবং স্বভাবত কারণেই এব্যাপারে কোন মন্তব্য করা বা লেখা শোভনীয় নয়। আমার লেখার বিষয় স্যারের কলামের উপর ভিত্তি করে; কোনভাবেই শহিদুল আলমের মামলার বিষয়ে নয়।
শুরুতেই বলে রাখা ভাল যে, স্যারের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলিট শ্রেনীর একধরণের ওঠাবসা বা যোগাযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাঙ্গালী চেতনার একাংশে বাস করে সুক্ষ্ম অনুভূতি, আর অন্যাংশে বাস করে স্বজনপ্রীতি, যাকে ভিন্ন ভাষায় বন্ধুসূলভতাও বলা যেতে পারে। স্বভাবত কারণেই আলোকচিত্রশিল্প শহিদুল আলমের সাথে স্যারের শ্রেনীগত এক ধরণের সখ্যতা থাকাটা অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু নয়!
স্যারের লেখাটা পড়লাম। একটু আগে বাঙ্গালী সংস্কৃতিগত যে দু’টো বিষয় উল্লেখ করেছি, স্যারের কলামের পুরোটা জুড়েই তার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি তাঁর লেখায় প্রথমত যে অনুভূতির আশ্রয় নিয়েছেন এবং স্যারের সাথে শহিদুল আলম সাহেবের পূর্বসখ্যতার যে ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং শেষমেষ নিজের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে যা কিছু বলতে চেয়েছেন, সবকিছু একত্র করে দাঁড়িয়েছে এই লেখাটি। তবে লেখাটির সর্বাংশে বাদ পড়েছে ঘটনার মূল বিষয়টি, যাকে কেন্দ্র করে এতো হৈচৈ, এতো বাহাস! পুরো লেখাটায় যে বিষয়ের উপর আলোকপাত করা উচিত ছিল, তা থেকে তিনি হাজার মাইল দূর দিয়ে হেটেছেন বা বলেছেন বললে ভুল বলা হবে না। তিনি বলেছেন, আল জাজিরায় শহিদুল সাহেব কি বলেছেন, তা তিনি শোনেননি। ফেইসবুক লাইভে শহিদুল সাহেব কি বলেছেন তা তো শোনেনই নাই, উপরন্ত ফেসবুক লাইভ কি তাও তিনি বোঝেন না বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ ঘটনার যে অংশটি মূল অনুঘটক সে ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞই শুধু নন; তার ধারকাছ দিয়েও চালাননি তাঁর কলম! অথচ জনাব শহিদুল আলমের ঘটনাকে নিয়ে বিশাল একটা লেখা লিখে ফেললেন!
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, শহিদুল সাহেবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ তা মূলত ফেসবুক লাইভ এবং আল-জাজিরায় দেয়া সাক্ষাতকারকে কেন্দ্র করে। এই দুই ঘটনা না ঘটলে দেশে-বিদেশে এতো হৈচৈও হতো না, স্যারকে কষ্ট করে দীর্ঘ লেখাটিও লিখতে হতো না। অথচ স্যার পুরোদস্তর একটা লেখা লিখলেন, কিন্তু মূল ঘটনা সম্বন্ধে নুন্যুতম ধারনা না নিয়েই লিখলেন। এটাকে আমি হটকারীতা বলবো, নাকি দায়িত্বজ্ঞানহীন বাক্যালাপ বলবো, তা এখনো প্রশ্নবোধক চিহ্নের নীচেই ঘুরপাক খাচ্ছে!
উনি বলেছেন যে, ‘পশ্চিমা মিডিয়া সাধারণত বাংলাদেশের ব্যাপারে এক ধরণের নেতিবাচক মনোভাব পোষন করে। সেজন্য তিনি পশ্চিমা কোন মিডিয়ার সাথে কখনো সাক্ষাতকার দেন না’। অথচ স্যার যেই ব্যক্তিটির ব্যাপারে লিখেছেন, তিনি আল-জাজিরা এবং ফেইসবুক লাইভে নিজ দেশের বিরুদ্ধে বিষদগার করার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন। সেখানে শহিদুল আলম সাহেব যে ভাষায় বিষদগার করেছেন, তা যদি শ্রদ্ধেয় স্যার নিজ কানে শুনতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, উনি এই লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন।
আমরা সবাই জানি এবং একবাক্যে স্বীকার করি যে, স্যার একজন খাটি “দেশপ্রেমিক” এবং দেশের প্রশ্নে তিনি কখনোই কারো কাছে মাথা নত করেন না। প্রসঙ্গত তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, বিদেশী মিডিয়া বাংলাদেশ সম্বন্ধে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব পোষন করে বলে তিনি সব সময়ই বিদেশী মিডিয়ার সাথে সাক্ষাতকার দেয়া থেকে বিরত থাকেন। যেই ব্যক্তি বিদেশী মিডিয়া সম্বন্ধে এই মনোভাব পোষণ করেন এবং সজ্ঞানে তাঁদের থেকে দূরে থাকেন, তিনি যদি শহিদুল আলম সাহেবের সাক্ষাতকার নিজ কানে আল-জাজিরায় শুনতেন এবং তিনি যদি শহিদুল সাহেবের ফেসবুক লাইভ শুনতেন, আমার বিশ্বাস অন্তত এই লেখা তাঁর কলম থেকে বেরোত না।
স্যারের লেখাটি যেদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেল, ঠিক সেদিনই বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় খবর এলো যে ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম বিদেশী মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন (https://goo.gl/NQCzUv)। অর্থাৎ যেই ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য নিজেই অনুতপ্ত হন এবং ক্ষমা চান, তাঁর পক্ষ নিয়ে সাফাই গাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ নিঃসন্দেহে এবং স্বাভাবিক ভাবেই বিব্রত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কলামটি লেখার সময় সম্ভবত জাফর ইকবাল স্যারের ভাবনায় বা হিসেবের মধ্যে ছিল না বিষয়টি। কারণ উনিতো আল-জাজিরার সাক্ষাতকারটি নিজ কানে শোনেননি এবং ফেসবুক লাইভ কি তাও তিনি জানতেন না।
যাইহোক, স্যারের এই লেখাটা কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অজ্ঞানতা থেকে লেখা, তা পাঠক সমাজই হয়ত বিচার করবেন। তবে পাঠক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠতার অভাবে এই লেখা স্যারকে তাঁর উচ্চতা থেকে কিছুটা হলেও নীচে নামিয়েছে এবং বোদ্ধামহলে স্যারকে কিছুটা হাল্কা করেছে বললেও হয়ত অতিরঞ্জিত করা হবে না!
এখানে একটা বিষয় স্বীকার না করলেই নয় যে, অনুভূতিপ্রবণ এবং সাদা মনের বাঙ্গালী হিসেবে স্যারের লেখাটা নিঃসন্দেহে চমৎকার, উচ্চ মার্গীয় এবং সুখোপাঠ্য, যা অনুভূতিপ্রবণ সরল বাঙ্গালীদের মনে পরোক্ষভাবে সরকাররের ব্যাপারে নেতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি করবে বলে আমি মনে করি। এছাড়াও স্যারের অর্জিত “সেলিব্রিটির” যে তকমাটি রয়েছে, সেটা এই লেখাটি উৎরে যাবার জন্য যথেষ্ঠ অবদান রাখবে।
সব শেষে ঠাট্রার ছলে হলেও একটা সন্দেহের কথা না বললেই নয়! এই লেখাটি লিখে সম্ভবত জাফর ইকবাল স্যার এলিট ক্লাবের একজন মেম্বার হিসেবে এবং ভবিষ্যতের পুলসিরতের পুল পার হবার জন্য একটা আগাম টিকেট কিনে রাখলেন। বলাতো যায় না কখন কি হয়!
সাব্বির খান
বিশ্লেষক ও সাংবাদিক